27 Nov 2024, 12:22 am

রাশিয়া ও ইউরোপের জ্বালানি সম্পর্ক ভেঙে পড়লো

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : কয়েক দশক ধরে খুব সূক্ষ্মভাবে ইউরোপের সঙ্গে তেল ও গ্যাস বাণিজ্য গড়ে তুলেছিল রাশিয়া। এটি ছিল দেশটির রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ। কিন্তু গত বছর ইউক্রেনে আক্রমণের পর এই বাণিজ্যিক সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। এখন এই সম্পর্ক এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, অদূর ভবিষ্যতে যেখান থেকে রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুব একটা দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

প্রায় এক বছর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে তার সেনাবাহিনী। এরপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং ইউরোপে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে হ্রাস পায় রাশিয়ার জ্বালানি রফতানি।

সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়াসহ সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার তেল বাণিজ্য আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু গ্যাসের চেয়ে অপরিশোধিত ও শোধন করা তেলের বিকল্প বাজার খুঁজে পাওয়া সহজ দেশটির জন্য।

ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার গ্যাস বাণিজ্যের ভিত্তি হলো হাজারো মাইল পাইপলাইন। যা সাইবেরিয়া থেকে শুরু হয়ে জার্মানি হয়ে ইউরোপের অপর দেশে পৌঁছেছে। গত বছরের আগ পর্যন্ত পশ্চিমা ক্রেতারা রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল।

১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার তেল ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইউরি শাফ্রানিক বলেন, ‘অবশ্যই, ইউরোপীয় বাজার হারানো রাশিয়ার গ্যাসের জন্য একটি বড় পরীক্ষা।’

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের এক সাবেক সিনিয়র ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে আরও সরাসরি বলেছেন, হাজারো মানুষের পরিশ্রম, কয়েক দশকে নির্মিত রফতানি ব্যবস্থা এখন একেবারে ভেস্তে গেছে।

তবে বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন, এটি স্বাভাবিক বাণিজ্য।

সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার এখতিয়ার না থাকা গ্যাজপ্রমের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের জন্য কিছু পাল্টায়নি। গত বছর দুবার আমাদের বেতন বেড়েছে।

আর্কটিক শহর নভি উরেঞ্জয়কে রাশিয়ার ‘গ্যাস রাজধানী’ হিসেবে মনে করা হয়। কারণ এখানে রয়েছে কয়েকটি বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র। রয়েছে গ্যাজপ্রমের কার্যালয়। ভিক্টোর চেরনোমিরদিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিকে ১৯৮৯ সালে গ্যাস শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই কোম্পানি গড়ে তোলা হয়েছিল।

শাফ্রানিক বলেন, চেরনোমিরদিন কখনও গ্যাজপ্রমে কাউকে নাক গলাতে দেননি। এটি ছিল রাষ্ট্রের ভেতর একটি রাষ্ট্র এবং এখনও প্রায় তা রয়েছে।

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারির আক্রমণের পর থেকে গ্যাজপ্রমের খুব বেশি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক রুশ কোম্পানির মতো এটিও নিজেদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে।

রফতানি ফি ও রফতানির পরিমাণের ভিত্তিতে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রাক্কলন হলো ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গ্যাজপ্রমের বিদেশিদের কাছে বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের তুলনায় ৬.৩ বিলিয়ন ডলার কম। রফতানির পূর্বাভাস ও গ্যাসের গড় মূল্য বিবেচনা নিলে এই বছর গ্যাজপ্রমের আয় হবে প্রায় অর্ধেক। এতে করে জানুয়ারিতে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়তে পারে।

ইতোমধ্যে গত বছর কোম্পানিটির প্রাকৃতিক গ্যাসের রফতানি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। যা সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে কম এবং বছরজুড়ে এই নিম্নগামী প্রবণতা বিদ্যমান থাকবে।

ইউরোপীয় কমিশন প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন ধারণা করছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আট মাসের মাথায় ইউরোপে গ্যাস সরবার ৮০ শতাংশ কমিয়েছে রাশিয়া।

এর ফলে পশ্চিম ইউরোপের চাহিদার বিপরীতে রাশিয়া মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করেছে। ২০২১ সালে রাশিয়া ৪০ শতাংশ চাহিদা মিটিয়েছিল।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া আত্মবিশ্বাসী ছিল ইউরোপে বিক্রি আরও বাড়বে, কমবে না।

২০১৯ সালে ভিয়েনায় এক অনুষ্ঠানে গ্যাজপ্রমের রফতানি ইউনিটের প্রধান এলেনা বুর্মিস্ত্রোভা বলেছিলেন, ২০১৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলোতে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস রফতানির লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এটি নতুন বাস্তবতা।

২০২২ সালে এই পরিমাণ ছিল ১০০ বিলিয়ন ঘনফুটের সামান্য বেশি।

রাশিয়া থেকে বাল্টিক সাগর হয়ে জার্মানি পর্যন্ত বিস্তৃত নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে রহস্যময় বিস্ফোরণে গত বছর মস্কোর গ্যাস সঞ্চালনের সক্ষমতা কমেছে। বিস্ফোরণগুলোর জন্য রাশিয়া ও পশ্চিমা একে অপরকে দায়ী করেছে।

পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী মার্কিন সাংবাদিক সেইমৌর হার্শ এক ব্লগে দাবি করেছেন, বিস্ফোরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যা দেশটির ‘ডাহা মিথ্যা’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

রুশ জ্বালানির প্রতি নির্ভরশীলতায় জার্মানির নীতির সমালোচনা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে ওয়াশিংটন। গত বছরও সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বার্লিন বলছে, এটি সম্পর্কের উন্নতির একটি পন্থা।

গত বছরের অনেক আগে থেকেই রাশিয়ার গ্যাসের বাজারে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে আসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। কিন্তু গত বছর তা মোমেন্টাম পেয়েছে।

অক্টোবরে তিনি তুরস্কে একটি ‘গ্যাস হাব’ গড়ে তোলার প্রস্তাব হাজির করেছেন। এর আওতায় বাল্টিক সাগর থেকে তুরস্ক হয়ে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে গ্যাস পাঠানো হতে পারে।

চীনের কাছে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস বিক্রিও বাড়াতে চায় রাশিয়া। বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি ভোক্তা দেশটি অপরিশোধিত তেল, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার একটি শীর্ষ ক্রেতা দেশ।

২০১৯ সালের শেষ দিকে পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইন দিয়ে চীনে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়েছে। রাশিয়ার লক্ষ্য ২০২৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৩৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চীনে রফতানি করা। বেইজিংয়ের সঙ্গে আরেকটি নির্মাণাধীন পাইপলাইন দিয়ে প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রফতানির চুক্তি করেছে মস্কো। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ সাখালিন থেকে এই পাইপলাইন শুরু হবে। সাইবেরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২ পাইপলাইন নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে রাশিয়া। এটি দিয়ে প্রতি বছর চীনে ৫০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।

তবে চীনের সঙ্গে এই সম্পর্ক ইউরোপে কয়েক দশক সরবরাহের মতো আকর্ষণীয় হবে কিনা সময় হলেই জানা যাবে।

১৯৬৬ সালে সোভিয়েত পলিটব্যুরো পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পাইপলাইনের বদলে গ্যাস বিনিময়ের আলোচনা শুরু করে। কারণ তখন রাশিয়ার উৎপাদন প্রযুক্তির ঘাটতি ছিল। এই আলোচনার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে ‘গ্যাসের বিনিময়ে পাইপ’ চুক্তি হয়। গ্যাসের বর্তমান মূল্যের হিসাবে ২০ বছরের সরবরাহ চুক্তির আর্থিক মূল্য ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার।

এর ফলে জার্মানি কয়েক দশক ধরে সাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির সুবিধা পায় এবং রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস বা মিথেনের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে।

অতীতের তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বেশি পড়েছে রাশিয়া। কারণ বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে আনতে চাইছে। এলএনজি বিশ্বের যেকোনও স্থানে পরিবহন করা যায়। এতে পাইপলাইন গ্যাসের চাহিদাও কমছে।

গত বছর ঘাটতির আশঙ্কার কারণে রাশিয়ার জ্বালানির অর্থায়ন সুবিধা পেয়েছিল। ইউক্রেনে আক্রমণের কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপে গ্যাসের মূল্য বেড়েছিল রেকর্ড মাত্রায়। আন্তর্জাতিক বাজারেও সর্বকালের সর্বোচ্চ দামের কাছাকাছি পৌঁছায় তা। এরপর থেকে গ্যাস ও তেলের দাম কমতে শুরু করে এবং ডিসেম্বরে রুশ গ্যাসের জন্য পশ্চিমাদের সর্বোচ্চ দাম কার্যকর হয়েছে। এতে চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়ার জ্বালানি আয় আরও কমেছে এবং কমবে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 11534
  • Total Visits: 1323072
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ বুধবার, ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ২৪শে জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ১২:২২

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018